বাজেটে সমন্বিত ভ্যাট হ্রাস করায় ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব কম আদায় হবে। তাই এই ঘাটতি পূরণে দেশবাসীকে যথাযথভাবে আয়কর প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার দশম জাতীয় সংসদে ১৬তম (বাজেট) অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে এ কথা বলেন। ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী এ সময় স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভ্যাট স্থগিত হওয়ার ফলে ২০ হাজার কোটি টাকার মতো আমাদের রাজস্ব আয় হ্রাস পাবে। আমরা দেখবো, বাজেটে কোথায় কীভাবে এটা অ্যাডজাস্ট করা যায় কিনা অথবা দেশবাসীকেও বলবো সবাই যদি আয়কর দেন সেটা কিন্তু তাদেরই উন্নয়নের কাজে লাগবে।’
শেখ হাসিনা জনগণের অর্থে দেশের উন্নয়নের প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, ‘জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে রাস্তাঘাট তৈরি হবে, মানুষের যাতায়াতের ব্যবস্থা হবে, আমরা বিদ্যুৎ ও ফসল উৎপাদন বাড়াতে পারবো। সবদিক থেকেই মানুষ উপকৃত হবে। এই সামান্য একটু ট্যাক্স দিলেই তিনি অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। তাতে আমাদের ঘাতটিও পূরণ হবে, দেশও উন্নত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৫-০৬ (বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার) সালের বাজেট ছিল ৬১ হাজার কোটি টাকা। সেখানে আজ ২০১৭-১৮ সালে আমরা দিয়েছি ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট। সেইসঙ্গে আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে বাজেট আমরা ৬ হাজার ২৫ ভাগ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি এবং আমাদের ২০১৬-১৭ অর্থবছর আমরা যে বাজেট দিয়েছিলাম, সাধারণত সবসময় আমরা বাজেট পর্যালোচনা করি এবং একটা পর্যায়ে কতটা ব্যয় করা সম্ভব তা নির্ধারণ করে কিছু কাটছাঁট করি।
তিনি বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সম্পূরক বাজেটে কোনো কাটছাঁট করিনি। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম কী পরিমাণ টাকা ব্যয় করে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পারি। আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। সেটা হলো ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আসাদের যে উন্নয়ন বাজেট ছিল প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার মধ্যে আমরা ১ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকাই উন্নয়ন বাজেটে ব্যয় করতে সক্ষম হয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, হয়তো অনেকে পারসেন্টেজ হিসাব করে অনেক বড় বড় পত্রিকার হেডলাইন করে ফেলেছেন। অনেকেই এটা একবারও দেখেননি যে কত কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট ছিল আর কত কোটি টাকার বাস্তবায়ন হয়েছে। আর ১ লাখ কোটি টাকার উপরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কে করতে পেরেছে? কে দিতেই বা পেরেছে। কোনো সরকার কোনোদিনও পারেনি। কেবল আওয়ামী লীগ সরকারই পেরেছে। সেদিক থেকেও আমরা বলবো একটা ইতিহাস আমরা সৃষ্টি করতে পেরেছি।
প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতার বক্তৃতার প্রেক্ষিতে রাজধানীর জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পেছনে পাকিস্তান আমলের আইয়ুবশাহী শুরু করে জিয়া, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং এরশাদ সরকারের জলাশয় ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ ও বক্স কালভার্ট নির্মাণের সমালোচনা করেন।
তিনি বলেন, মতিঝিল, শান্তিনগর, সেগুনবাগিচা এবং ধোলাইখাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে রাজধানীতে কেবল আন্ডারগ্রাউন্ডে পানি টেনে নেয়ার মাধ্যমে জলবদ্ধতা সবসময় দূর করা যাচ্ছে না।
শেখ হাসিনা উদাহারণ হিসেবে বলেন, সচিবালয় এবং তেজগাঁও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মুখের জলাবদ্ধতা দূর করতে তাঁর সরকার রাস্তার নিচে দিয়ে ক্যানেল কেটে সচিবালয়ের আন্ডারগাউন্ডের সঙ্গে ওসমানী উদ্যানের পুকুরটির সংস্কার করে তার সঙ্গে সংযোগ করে দেয়ায় তাতে পানি সরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আন্ডারগ্রাউন্ডের পানি সরার পথের সঙ্গে তেজগাঁও বিমানবন্দর এলাকায় এসএসএফ’র একটি ক্যানেলের সংগে সংযোগ করে দেয়াতেই পানি সরার সুযোগ পাচ্ছে। এরকম পানি সরানোর সুযোগ না দিয়ে কেবল আন্ডারগ্রাউন্ড লাইন দিয়ে রাজধানীর জলাবদ্ধতা সহজেই দূর করা যাবে না বলেও জানান।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় ভূমি খেকোদের দখলের জন্যই রাজধানীতে আজকের জলাবদ্ধতা বলেও মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের জন্য কোনভাবেই বক্স কালভার্ট প্রযোজ্য নয়। রাস্তা থাকলে তাঁর দু’পাশ দিয়ে খাল থাকবে। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে না।’
সরকারের আপদকালীন খাদ্য মজুদের উদ্যোগ প্রসংগে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যেমন খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পেরেছি তেমনি হাওড় এলাকায় এবারের বন্যায় কিছু খাদ্য নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তা দেখে আমরা বসে থাকিনি। আমরা খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে যদি বড় আকারের কোন বন্যা দেখা দেয় তাহলে তা মেকাবেলার জন্য বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে তা মজুদ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। কোনোরকম বিপদ হলে আমাদের দেশের মানুষ যেন কোনোরকম কষ্ট না পায়। একইসঙ্গে যেখানে যেখানে বন্যা হচ্ছে- সেখানে আমাদের সংগঠন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে টিম তৈরি করে প্রত্যেক জায়গাতেই আমরা পাঠিয়েছি। আর আমাদের ত্রাণ মন্ত্রণালয়ও সক্রিয়। মন্ত্রী নিজেই সকল জায়গায় যাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এবং বন্যার পানি সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এজন্য এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টার তৈরি রয়েছে বলেও তিনি সংসদকে জানান।
এছাড়া সামনে কোরবানির ঈদকে লক্ষ্য ধরে সরকার দেশে লবণ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে বলেও সংসদ নেতা তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী খাদ্যে বিষক্রিয়া সম্পর্কিত বিরোধীদলীয় নেতার বক্তৃতার জবাবে বলেন, তিনি একটু চিন্তিত খাদ্যে বিষক্রিয়া, ভেজাল ও ফরমালিন নিয়ে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছি এবং ফরমালিন বন্ধে এবং তা আমদানির ক্ষেত্রেও আমরা তদারকির ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন আর ফরমালিন তেমন নেই। এমনকি রমজান মাসেও প্রতিটি জায়গায় মোবাইল কোর্ট সক্রিয় ছিল। কোথায় ভেজাল রয়েছে, কোথায় খারাপ খাবার তৈরি হচ্ছে সেসব বিষয় যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। এটা চলমান রয়েছে।
আমের দিনে আমও নিশ্চিন্তে এখন খেতে পারেন উল্লেখ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই মোবাইল কোর্ট এসব পরীক্ষা করে আসাতেই ফরমালিন এখন নেই।
শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের নেতৃত্বে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উল্লেখ করে বলেন, গ্রামীণ মাঠ পর্যায় থেকে আমাদের উন্নতি হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়া দরিদ্র মানুষ ও গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছেছে। এটাই হচ্ছে আমাদের নীতিমালা, যেটা সফলভাবেই আমরা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা তেলামাথায় তেল দেয়া নয়, ধনীকে আরো ধনী করা নয়, উন্নয়ন যেন একদম হতদরিদ্র মানুষের দোড়গোঁড়ায় পৌঁছতে পারে। সেভাবে আমরা নীতিমালা নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছি বলেই আজ সমগ্র বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ উন্নয়নের বিস্ময় এবং রোল মডেল।